🔶 কারবালার সঠিক ইতিহাস 🔶 সকল পর্ব একত্রে 🔶 হিজরি : ১৪৪৫ 🔶

⚜️⚜️⚜️⚜️⚜️⚜️ بِسمِ اللَّهِ الرَّحمٰنِ الرَّحيم ⚜️⚜️⚜️⚜️⚜️⚜️ 

 ⚜️ কারবালার সঠিক ইতিহাস ⚜️ 

⚜️ ধারাবাহিক পর্ব : ০১ ⚜️ 

⚜️ হিজরি : ১৪৪৫ ⚜️ 

✒️প্রসঙ্গ কথাঃ 

একজন মুসলমান হিসেবে কারবালার ইতিহাস জানা অবশ্য কর্তব্য। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠিতে বিভিন্ন ভাষায় কারবালার ঘটনা নিয়ে যত লেখা হয়েছে সম্ভবত আর কোন ঘটনা নিয়ে এত লেখা হয়নি। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, অধিকাংশ লেখায় পাঠকদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সঠিক ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। 

বাংলা ভাষায়ও এমন বিভিন্ন প্রকার সাহিত্যের উদাহরণ অনেক। সবচেয়ে বড় উদাহরণ “বিষাদ সিন্ধু”। এই ঈমান বিধ্বংসী বইয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদার যে কী অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। মূলতঃ এটাই স্বাভাবিক। কেননা মীর মশারফ ছিল শিয়া বা রাফেজী ধর্মাবলম্বী। আর শিয়ারা পবিত্র ইসলামী শরীয়াহ মুতাবিক অবশ্যই কাফির। কেননা ঈমান ও কুফরের পার্থক্য আমলে নয়, আক্বীদা বা বিশ্বাসে। 

🔴 প্রায় বাইশটি শাখা প্রশাখায় বিভক্ত শিয়াদের কতিপয় আক্বীদা নিম্নে দেয়া হল :— 

📌 শিয়ারা বলে : আখিরী নাবী, হুযূর পাক রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ} নন, নাবীজির সাহাবী ও জামাতা হযরত আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} শেষ নাবী হবার কথা। ফিরিশতা জিবরাঈল {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎} ভুল করে রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}-এর উপর ওহী নিয়ে এসেছেন। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) 

📌 শিয়ারা বলে : আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} ক্বুরআন শারীফে চৌদ্দ হাজার আয়াত নাযিল করেছিলেন। মুহাম্মাদ {ﷺ} সেখান থেকে আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর ইমামত সংক্রান্ত সকল আয়াত বাদ দিয়ে বাকিটুকু (ক্বুুরআন শারীফ) প্রচার করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) 

📌 শিয়ারা বলে : হুযূর পাক {ﷺ}-এর বিসাল শারীফ বা ইন্তেকাল এর পর আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, হাসান  {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, হুসাইন  {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ও সালমান ফারসি {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}— এই পাঁচ জন ছাড়া সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম কাফের, মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলেন। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) আর এসব কাফিরদের নেতা আবু বাকর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, উমার {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, উসমান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) 

📌 শিয়ারা বলে : একটা শুকরও তত নাপাক নয় যতটা নাপাক আবু বাকার, উমার, উসমান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) 

📌 শিয়ারা সব সময় একটা মাটি অথবা পাথরের টুকরা সাথে রাখে। নামাযের সময় সেটি সিজদার স্থানে রাখে। কারণ তারা মনে করে সরাসরি আরদ্ বা জমিন বা মাটিতে সিজদা দিলে নামায হবে না। (নাউজুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) অতএব হুযূর পাক {ﷺ} তিনি সহ কোনো সুন্নী মুসলমানের নামায হয়না, কারণ মুসলমানগণ সরাসরি মাটি, পাকা বা ফ্লোরে, জায়নামাজের উপর সিজদা আদায় করে থাকেন। (নাউজুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) 

📌 শিয়াদের ইমামদের মর্যাদা পূর্ববর্তী নাবীগণের চেয়ে বেশি। (নাউজুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) 

📌 প্রাণীর ছবি আঁকা, আঁকানো, রাখা হারাম কিন্তু প্রাণীর ছবি তোলা, তোলানো এবং রাখা জায়িয। (নাউজুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) আর তাই তারা তাদের নেতাদের ছবি তোলে এবং মসজিদসহ সর্বত্র টাঙিয়ে রাখে। (নাউজুবিল্লাহ্ মিন যালিক!!!) 

এরকম আরো অসংখ্য ও অগণিত কুফরি পূর্ণ আক্বীদার কারণে ইসলামী শরীয়াহ্ মুতাবিক শিয়া বা রাফেজীরা নিঃসন্দেহে কাফির এবং হাদীস শারীফের বর্ণনা অনুযায়ী বাতিল বাহাত্তর দলের অন্তর্ভুক্ত। 

👉 আর এভাবেই বিভিন্ন বাতিল দল মাযহাবের ভ্রান্তিমূলক বিশ্বাস ও কাল্পনিক ধ্যান ধারণার মিশ্রন থেকে সৃষ্ট গল্প-উপন্যাস যুগে যুগে কারবালার প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি মুসলমানদের আত্মমর্যাদা-স্বকীয়তাবোধের অভাব, জ্ঞান অর্জনে অনীহা, সৎকর্মবিমুখতা ইত্যাদি ও মুসলমানদের বিভ্রান্তির বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। 

আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি একজন মানুষও উপকৃত হয় তবে তা আসমান জমিনের সবকিছুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবে। আর অজানায় বা অনিচ্ছায় সকল ভুল-ত্রুটি, বেয়াদবী-গুস্তাকির জন্য আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর কাছে ক্ষমা চাই। আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} আমাদের সবাইকে উনার হাবিব {ﷺ}-এর ওয়াসিলায় ক্ববুল করুন। আমিন। 

🔶 মহান আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} ক্বুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, 

—“যারা আল্লাহ্ তা‘য়ালার রাস্তায় শহীদ হন তাঁদের তোমরা মৃত বলনা। নিশ্চয় তাঁরা রব তায়ালার পক্ষ থেকে জীবিত ও রিজিকপ্রাপ্ত।”-[সূরাহ্ : আলে ইমরান, পবিত্র আয়াত : ১৬৯] 

সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাহাদাত নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা। নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক {ﷺ}-এর হায়াত মুবারকে ও উনার বিসাল শারীফের পর অনেক মর্ম বিদারক শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাহাদাতের ন্যায় এত দীর্ঘস্থায়ী ও এত ব্যাপক শোক, আহাজারি মুসলিম জাতি আর কোন শাহাদাতের জন্য করেনি। 

নাবী কারীম {ﷺ}-এর চাচা সাইয়িদুনা হযরত হামযাহ্ {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাহাদাত, সাহাবী সাইয়িদুনা হযরত ইয়াসার {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর ও উনার পরিবারের মর্মান্তিক শাহাদাত, বীরে মাউনায় ৭০ জন এবং ইয়ামামার যুদ্ধে ৩০০ জন কুরআনে হাফিজের শাহাদাত, সাইয়িদুনা হযরত খুবাইব {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ও উনার সঙ্গীদের শাহদাত তৎকালীন ও বর্তমান মুসলিম সমাজের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। 

খুলাফায়ে রাশিদীন এর ৩ জন যথাঃ সাইয়িদুনা হযরত উমার ফারুক্ব {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, সাইয়িদুনা হযরত উসমান যুন্নূরাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর হৃদয়বিদারক শাহাদাত, সাইয়িদুনা হযরত আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} এবং আহলে বাইতে রাসূলিল্লাহ্ {ﷺ}, জামাল (উষ্ট্রের) ও সিফ্ফীনের মত দুইটি গৃহযুদ্ধে বহু মূল্যবান প্রাণ বিশেষতঃ আশারায়ে মুবাশশারাহ্ এর কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাহাদাত অবশ্যই অত্যন্ত শোকের। তবে সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাহাদাত শোক ও আবেগের বিবেচনায় সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। এমনকি উনার বড় ভাই, ইমামগণের মধ্যে যিনি দ্বিতীয়, সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হাসান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে বিষ প্রয়োগে শাহাদাতের ঘটনায়ও এত দীর্ঘস্থায়ী শোক বিলাপ হয়নি যতটা ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর জন্য হয়েছে এবং হবে ইনশাআল্লাহ্। 

মোটকথা, এ এক এমন অসাধারণ ও অনন্য ঘটনা, এক হৃদয় বিদারক ইতিহাস যার পূর্বে ও পরে আর এমন কোন নজির নেই, সুবহানাল্লাহ্! 

🔶 আহলে বাইত ও আওলাদে রাসূলগণের {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} পরিচয়ঃ 

আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর হাবীব খতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন, নূরে মুজাসসাম, হুযূর পাক {ﷺ}-এর চারজন পুত্র সন্তান ছিলেন। যাঁরা প্রত্যেকে নাবালক বয়সে ইন্তেকাল করেন। কেননা সাধারণত নাবীগণ {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎}-এর সন্তান নাবীই হন আর আল্লাহ্ পাক উনার হাবীব {ﷺ} আখেরী নাবী ও রাসূল তাই আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} উনাদের অল্পবয়সেই জান্নাতে প্রত্যাবর্তন করান। 

উনারা হলেন :— 

🔸১. সাইয়িদুনা হযরত ক্বাসিম {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, 

🔸২. সাইয়িদুনা হযরত ত্বাইয়িব {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, 

🔸৩. সাইয়িদুনা হযরত ত্বাহির {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} এবং 

🔸৪. সাইয়িদুনা হযরত ইবরাহীম {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}। 

হুযূর পাক {ﷺ}-এর আরও চারজন কন্যা সন্তান ছিলেন। 

উনারা হলেন :— 

🔸১. সাইয়িদা যায়নাব {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}, 

🔸২. সাইয়িদা রুকাইয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}, 

🔸৩. সাইয়িদা উম্মু কুলসুম {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎} এবং 

🔸৪. সাইয়িদা ফাতিমা যাহরা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}। 

আর সাইয়িদা ফাতিমা যাহরা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}-এর দুই সন্তান সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হাসান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ও সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর মাধ্যমেই নাবী কারীম {ﷺ}-এর বংশধারা জারী হয়েছে। ক্বিয়ামাত পর্যন্ত এই বংশধারা জারি থাকবে। সাইয়িদুনা হযরত আলী কাররামাল্লাহু {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, সাইয়িদা ফাতিমা যাহরা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}, সাইয়িদুনা হাসান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, সাইয়িদুনা হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}— উনারা এবং উনাদের মাধ্যমে ক্বিয়ামাত পর্যন্ত যাঁরাই পৃথিবীর বুকে আগমন করবেন তাঁরাই “আহলে বাইত” তথা নাবী {ﷺ} উনারা পরিবারবর্গের অন্তর্ভুক্ত, সুবহানাল্লাহ্! 

যাঁরা আওলাদে রাসূল বা সাইয়িদ/সৈয়দ হিসেবে পরিচিত। অঞ্চল বিশেষে তাঁরা মীর, খন্দকার, মিয়াজী হিসেবেও পরিচিত। 

👉 এখন এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। উনাদের মধ্যে থেকে আবার যদি কেউ দুনিয়া পরস্ত হয়ে ইসলাম বিরোধী কাজ তথা হারাম নাজায়িয কাজে, কুফরি শিরকীতে লিপ্ত হয় তবে নিশ্চয়ই তারা নাবী {ﷺ} পরিবার থেকে খারিজ বলে সাব্যস্ত হবে। যেমন পবিত্র ক্বুরআন শারীফের বর্ণনা অনুযায়ী ‘কাবিল’ নাবী হযরত আদম {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎}-এর পরিবার থেকে, ‘কিনান’ হযরত নূহ {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎}-এর পরিবার থেকে এমনকি নিকৃষ্ট ‘ইয়াজিদ’ হযরত আমিরুল মু’মিনীন মু‘আবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর পরিবার থেকে খারিজ বলে সাব্যস্ত হয়েছে। অতএব আওলাদে রাসূল দাবি করে সর্বক্ষণ হারাম নাজায়িয কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের সাবধান করতে হবে, তাদের ক্বুরআন মাজীদ ও হাদীস শারীফের প্রামান্য দলিল পেশ করে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। তা যদি সম্ভব না হয় তবে তাদেরকে তাদের মত ছেড়ে দিতে হবে। তাদের সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকতে হবে। এটিই হবে তাদের জন্য সর্বোত্তম ইহসান। 

🔶 ক্বুরআন ও হাদীস শারীফ এর বর্ণনায় আহলে বাইত ও আওলাদে রাসূলগণের {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ফাযীলাতঃ 

সংক্ষিপ্ত পরিসরে আওলাদে রাসূল/আহলে বাইত উনাদের মর্যাদা, মর্তবা, ফাযীলাত বর্ণনা করা খুবই কঠিন। এখানে কিছু আয়াত শারীফ ও হাদীস শারীফ উল্লেখ করা হল। 

মহান আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} পবিত্র ক্বুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন,—“ক্বুল লা-আস আলুকুম আলাইহি আজ্-রন ইল্লা মাওয়াদ্দাতা ফিল ক্বুরবা।” 

অর্থ : হে হাবীব {ﷺ}! আপনি (আপনার উম্মাতদের) বলে দিন, আমি তোমাদের কাছে নাবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের কোন প্রতিদান চাইনা। তবে আমার নিকটজন (তথা আহলে বাইতগণের) প্রতি সদাচরণ করবে।”-[সূরাহ্ : শূরা, আয়াত : ২৩] 

এই আয়াত শারীফের ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত তাফসীর ‘তাফসীরে মাযহারী’ এর অষ্টম খণ্ডের ৩২০ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়,—“আমি তোমাদের কাছে প্রতিদান চাইনা তবে আমার নিকটাত্মীয়, আহলে বাইত ও বংশধরগণের (যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক) হক্ব আদায় করবে। কেননা আল্লাহ্ পাক আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর হাবীব {ﷺ} শেষ নাবী। উনার পরে আর কোনো নাবীর আগমন ঘটবে না।” 

‘মুত্তাফাকুন আলাইহি’ অর্থাৎ বুখারী শারীফ ও মুসলিম শারীফে উম্মুল মু’মিনীন সাইয়িদা আইশা সিদ্দীক্বা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}, সাইয়িদুনা হযরত সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, সাইয়িদুনা হযরত মিসওয়ার ইবনে মাখরামা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, সাইয়িদুনা হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, সাইয়িদুনা হযরত বা’রা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত হাদীস শারীফ সমূহের সারবস্তু হচ্ছে,—“সাইয়িদা ফাতিমা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}, সাইয়িদুনা হযরত আলী কাররামাল্লাহু {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}, সাইয়িদুনা হযরত হাসান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ও সাইয়িদুনা হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} উনারা খাস আহলে বাইত। আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} উনাদের থেকে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূর করেছেন। তাঁদের রাগান্বিত করা, কষ্ট দেয়া রাসুল {ﷺ}-কে কষ্ট দেয়ার নামান্তর। হুযূর পাক {ﷺ} ‘খোম’ নামক স্থানে দাঁড়িয়ে একাধিক বার আহলে বাইত সম্পর্কে বিশেষ নসীহত করেন।” 

এছাড়াও তিরমিযী শারীফ, মুসনাদে আহমদ শারীফ, আবু দাঊদ শারীফ সহ অনেক হাদীস শারীফের ভাষ্যমতে,—“হুযূর পাক {ﷺ} যে দুটি জিনিস রেখে গেছেন তা হলো আল্লাহর কিতাব (ক্বুরআন শারীফ) ও আহলে বাইত। আহলে বাইতগণ হযরত নূহ্ {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎}-এর কিশতি (জাহাজ)-এর মত। যে তাতে আরোহণ করবে সে নাজাত পাবে, যে করবে না সে ধ্বংস হবে। হযরত ইমাম হাসান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ও হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} উনারা দুনিয়াতে হুযূর পাক {ﷺ}-এর দুটি ফুলস্বরুপ এবং উনারা জান্নাতী যুবকদের সাইয়িদ (সর্দার)।” 

ক্বুরআন শারীফ ও সুন্নাহ শারীফ থেকে উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রতিয়মান হয় যে, আহলে বাইতগণ {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} সীমাহীন মর্যাদা মর্তবার অধিকারী। আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} ও উনার হাবীব হুযুর পাক {ﷺ}-এর সন্তুষ্টি হাসিল করতে হলে আহলে বাইতগণের মুহব্বত করা, তা’যীম-তাকরীম করা প্রত্যেক বান্দাহ্ ও উম্মাতের জন্য অবশ্য কর্তব্য। 


⚜️ কারবালার সঠিক ইতিহাস ⚜️ 

⚜️ ধারাবাহিক পর্ব : ০২ ⚜️ 

⚜️ হিজরি : ১৪৪৫ ⚜️

🔶 সাইয়িদুশ শুহাদা সাইয়িদু শাবাবি আহলিল জান্নাত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} : 

হিজরী ৪র্থ সনের শা’বান মাসের ৫ তারিখ সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} মাদীনা শারীফে জন্ম গ্রহণ করেন। স্বয়ং সাইয়িদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন হুযুর পাক {ﷺ} তাঁর কানে আজান দেন, দু‘আ করেন এবং ৭ম দিন আকীকা করে তাঁর নাম রাখেন হুসাইন। 

হাদীস শারীফে বর্ণিত আছে, সাহাবী সাইয়িদুনা হযরত আবু রাফি {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,—“যখন হাসান ও হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} জম্মগ্রহণ করলেন তখন রাসূলে আকরাম {ﷺ} স্বয়ং তাদের উভয়ের কানে আযান দিয়েছেন।” [রেফারেন্স : তাবরানী। আল মুজামুল কবির খন্ড নং : ১, পৃষ্ঠা নং : ৩১৫, হাদীস নং : ৯৩১। হায়ছমি, মাজমাউজ জাওয়ায়িদ খন্ড নং : ৪, পৃষ্ঠা নং : ৬০] 

হাদীস শারীফে আরো বর্ণিত আছে, সাহাবী সাইয়িদুনা হযরত ইমরান বিন সুলাইমান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘হাসান’ ও ‘হুসাইন’ জান্নাতিদের নামসমূহের দুটি নাম। যে দুটি নাম জাহেলি যুগে কারো নাম হিসেবে রাখা হয় নি।” [রেফারেন্স : ইবনে হাজর মাক্কী, আস সাওয়ায়িকুল মুহরাকা, পৃষ্ঠা নং : ১৯২, ইবনে আসির, উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা, খন্ড নং : ২, পৃষ্ঠা নং : ২৫] 

হুযুর পাক {ﷺ} ইরশাদ করেন,—“যে ব্যক্তি এই দু’জনকে ভালবাসলাে, মূলতঃ সে আমাকেই ভালবাসলাে এবং যে এই দু’জনের সাথে শত্রুতা পােষণ করলাে, মূলতঃ সে আমার সাথেই শত্রুতা পােষণ করলাে।” [রেফারেন্স : ইবনে মাজাহ্। কিতাবুস সুন্নাহ্। বাবু ফি ফাযায়ীলে আসহাবে রাসূলুল্লাহ্ খন্ড নং : ১, পৃষ্ঠা নং : ৯৬, হাদীস নং : ১৪৩] 

হাদীস শারীফে বর্ণিত রয়েছে, একদিন হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে হুযুর পাক {ﷺ}-এর কোলে ছিলেন। নাবীজি {ﷺ}-এর চাচীজান সাইয়িদা উম্মুল ফজল {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎} হুযুর পাক {ﷺ}-এর দিকে তাকালে দেখতে পান যে হুযুর পাক {ﷺ}-এর চোখ মুবারক থেকে অঝোরে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। সাইয়িদা উম্মুল ফজল {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎} আরজ করলেন,—“ইয়া রাসূলাল্লাহ্! হঠাৎ চোখে পানি কেন?” হুযুর পাক {ﷺ}-এর ইরশাদ করেন, এই মাত্র হযরত জিবরাঈল {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎} এসে এ খবর দিয়ে গেলেন, নিশ্চয়ই আমার উম্মাত আমার এ শিশুকে (দৌহিত্র/নাতি) শহীদ করবে। হযরত জিবরাঈল {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎} আমাকে সেই জমিনের মাটি এনে দিয়েছেন যেখানে আমার এ শিশু শহীদ হবে। হুযুর পাক {ﷺ} সেই মাটি শুঁকে দেখলেন এবং বললেন,—“এ মাটি থেকে আমি কারবালার সুঘ্রান পাচ্ছি।” অতঃপর সেই মাটি (হুযুর {ﷺ}-এর স্ত্রী) সাইয়িদা উম্মে সালমা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}-কে দিলেন এবং বললেন,—“হে উম্মে সালমা, এ মাটি তোমার কাছে রেখো। যখন এ মাটি রক্ত হয়ে যাবে তখন বুঝিও যে আমার এ নানু শহীদ হয়ে গেছে।” উম্মুল মু’মিনীন সাইয়িদা উম্মে সালমা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎} এ মাটি একটি শিশিতে ভরে যত্ন সহকারে রেখে ছিলেন।” যে দিন সাইয়িদুনা হযরত ইমাম ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} কারবালা ময়দানে শহীদ হন, সেই দিন এ মাটি মুখবন্ধ শিশিতে রক্তে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।” [রেফারেন্স : মিশকাত শারীফ পৃষ্ঠা নং : ৫৬৪। হাকিম খন্ড নং : ৩, পৃষ্ঠা নং : ১১৬ — ১১৭।] 

হযরত ইবনে সা’দ {رحمة الله عليه} এবং হযরত শা’বী {رحمة الله عليه} থেকে বর্ণনা করেন,—“সিফফিনের যুদ্ধের সময় সাইয়িদুনা হযরত আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} কারবালার পথ দিয়ে যাবার সময় থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই জায়গার নাম জানতে চাইলেন। লোকেরা বললেন,—“এই জায়গার নাম কারবালা।” এটা শুনা মাত্রই তিনি এত কান্নাকাটি করলেন যে উনার পবিত্র দাড়ি ভিজে গিয়ে চোখের পবিত্র পানি জমিনে পড়তে লাগলো। তারপর সাইয়িদুনা আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—“একদা আমি হুযুর পাক {ﷺ}-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে দেখলাম তিনি {ﷺ} কাঁদছেন। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}! আপনি কেন কাঁদছেন?” দু’জাহানের বাদশাহ, পেয়ারা নাবী, ঈমান ও মুহাব্বাতের মূল, নূরের নাবী {ﷺ} পবিত্র চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ইরশাদ করেন,—“এইমাত্র হযরত জিবরাঈল {عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‎} এসে আমাকে খবর দিলেন যে আমার ছেলে (দৌহিত্র) হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে ফুরাত নদীর তীরে যে স্থানে শহীদ করা হবে তার নাম ‘কারবালা’।”-[রেফারেন্স : সাওয়ায়িকে মুহাররাকাহ্।] 

সাইয়িদূশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} শাহাদাত বরণ করবেন এটিই ছিল আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর অপরিবর্তনীয় ইচ্ছা। যে ভবিষ্যদ্বাণী হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে। তবে কেন আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} ও রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}-এর এমন হৃদয়বিদারক ইচ্ছা ও কুরবানি? মূলতঃ এই পবিত্র ও অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল সেই সময় এবং ক্বিয়ামাত পর্যন্ত উম্মাতের জন্য পরীক্ষা যে, কে হক্ব বা ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয় আর কে নাহক্বের দলে। কে মুমিন, আলিম, মুহসিন বান্দা ও আশিক্বে রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ} আর কে ফাসিক, জালিম, মুনাফিক্ব, কাফির। এই অভূতপূর্ব ঘটনা ক্বিয়ামাত পর্যন্ত হক্ব ও নাহক্বের পার্থক্য স্পষ্ট প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করে দিলো। 

🔶 কুখ্যাত ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর মসনদ দখল : 

বিশিষ্ট সাহাবী আমীরুল মু’মিনীন, খলিফাতুল মুসলিমীন, কাতীবে ওহী, সাইয়িদুনা হযরত মু‘আবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর বিছাল (ইন্তেকাল) শারীফের পর তাঁর পুত্র ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} মসনদে আরোহন করে এবং ক্ষমতারোহনের পর পরই সে আমূল পরিবর্তিত হয়। যে সকল সদাচরণ ও সৎ গুনাবলির কারণে হযরত আমির মু‘আবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} তার পুত্র ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর প্রতি আস্থা রেখেছিলেন, সর্বোপরি পুনঃবার উম্মাহকে ফিতনা ও বিভক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য তাকে যে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, ক্ষমতারোহনের পর পরই ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} ঠিক তার বিপরীত রূপ প্রকাশ করে। 

সে সেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে এবং মহান দ্বীনী শারী‘আতের বিরুদ্ধে কাজকর্ম শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে ও পদে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের সরিয়ে ফাসিক-ফুজ্জার, অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেয়। মদ ও নারীর প্রতি যথেচ্ছ ব্যবহার প্রচলন করে। ইসলামী শারী‘আতে যে সকল নারী বিয়ে করা অবৈধ, তেমন নারীদের বিয়ের জন্য সে প্রলুব্ধ হয়। জুয়ার প্রচলন করা হয়। এক কথায় ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} এমন সব কার্যকলাপ শুরু করলো যা একজন মুসলমান মাত্রই করতে পারেনা, খলিফা তো নয়ই। তার এসব ধর্মদ্রোহী কার্যকলাপে ইসলামী শারীআতের শাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। 

ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} ধৃষ্টতার চরম পর্যায়ে এসে সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবীদের কাছ থেকে বাইয়াত তলব করলো। একে তো ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর অনৈসলামিক কার্যকলাপে তাঁরা অসন্তুষ্ট ছিলেন তারপর তার এমন বেয়াদবিমুলক আচরণ- এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো। 

সাইয়িদুনা হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ও সাইয়িদুনা হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} মাদীনা শারীফ ত্যাগ করে মাক্কাহ্ শারীফ চলে গেলেন। 

মাদীনা শারীফে ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} কর্তৃক নিয়োজিত বেয়াদব গভর্নর ওয়ালিদ {লা’নাতুল্লাহ্} হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে বলেছিলো,—“ইয়াযিদ আপনার বাইয়াত তলব করেছেন এবং এটি আপনার জন্য বাধ্যতামূলক।” 

জবাবে ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বলেছিলেন,—“আমি এটা কী করে করতে পারি? তার মতো অনুপযুক্ত লোকের হাতে আমি বাইয়াত করতে পারিনা। আমি কোনো অবস্থায় এ ব্যাপারে রাজী নই।” তিনি সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন এবং এটা তাঁর মর্যাদাগত সদাচরণই ছিল।” সুবহানাল্লাহ্! 

মূলতঃ তিনি যদি ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর প্রস্তাবে রাজী হতেন তবে অনেক কিছুই হতে পারতো। সর্বোপরি যা হতো তাহলো, পবিত্র দ্বীন ইসলামের আইন-কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং ক্বিয়ামাত পর্যন্ত ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য জায়িয বা বৈধ হয়ে যেত। ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} প্রমাণ করে দিলেন যে, যত বড় বাঁধা বা হুমকি হোক না কেন তিনি কখনোই আল্লাহ্ পাক {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} ও তাঁর নানাজান রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}-এর প্রবর্তিত দ্বীন ইসলামের অবমাননা সহ্য করেননি। ধর্মকে ধ্বংসের মুখে ছেড়ে দেননি এবং সত্য কখনোই মিথ্যার কাছে মাথা নত করে না... করতে পারেনা। 

সাইয়িদুশ শুহাদা, সাইয়িদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ, রাইহানুর রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}, মাওলা, আক্বা সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} নিজের আমল ও কর্মপন্থা দ্বারা তাঁর উচ্চ মর্যাদার পরিচয় দিয়েছেন এবং জনগণের কাছে উনার শান-মান তুলে ধরেছেন। 

🔶 সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর মাদীনা শারীফ ত্যাগ ও তার কারণ : 

ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} তাঁর পরিবারের সকলকে একত্রিত করে বলেন,—“হে আমার প্রিয়জনেরা ! ইয়াযিদ এমন প্রস্তাব করেছে যা আমি কখনোই গ্রহণ করবো না। তারা আমাকে বাধ্য করলে নিশ্চয়ই যুদ্ধ হবে, ফাসাদ হবে। কিন্তু আমি চাইনা মাদীনা শারীফে কোনো লড়াই বা ফাসাদ হোক। এ অবস্থায় আমার মতে এটাই উত্তম, হিজরত করে মাক্কাহ্ শারীফ চলে যাওয়া।” 

আপনজনেরা বললেন,—“আপনি আমাদের অভিভাবক, আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমরা তাই মেনে নিব।” 

আহ্! পরিস্থিতি কতটা নাজুক হলে ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়! যে মাদীনাওয়ালা রাসূল {ﷺ} আগমন করবেন বলে হাজার বছর আগে থেকে সুসজ্জিত হয়েছে মাদীনা মুনাওয়ারা, যে মাদীনা নাবী পাক {ﷺ}-এর প্রেমে ছিল মাতোয়ারা, যে মাদীনার ওলীতে গলীতে হেসে খেলে বড় হয়েছেন আওলাদে রাসূলগণ, আজ সেই মাদীনা শারীফ সম্মানিত আওলাদগণকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। 

সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} তাঁর নানাজান {ﷺ}-এর পাক রওযা শারীফে উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করেন এবং অশ্রুসজল নয়নে হিজরতের অনুমতি নিলেন। এরপর তিনি আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে হিজরী ৬০ সনের ৪ঠা শা’বান মাক্কাহ্ শারীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। 

📌 মাদীনা শারীফ ত্যাগপুর্বক মাক্কাহ্ শারীফে গমণের কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণের ২টি মত প্রদান করেছেন। 

👉 প্রথমত, মূলতঃ ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} যে কার্যক্রম শুরু করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত সম্মানিত সাহাবীগণ {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ও আহলে বাইতগণ {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর প্রতি ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর যে মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছিলো তাতে ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} মাদীনা শারীফে ফিতনা ফাসাদের আশংকা করছিলেন। তাই বিশিষ্ট সাহাবীগণ {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ইতিপূর্বেই মাদীনা শারীফ ত্যাগ করেন। 

👉 দ্বিতীয়ত, ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} আশা করেছিলেন, মাক্কাহ্ মুকাররমা শান্তি ও নিরাপত্তার শহর হিসেবে উনার জন্য নির্দিষ্ট হবে। কেননা আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎} ইরশাদ করেন,—“ওয়া মান দাখালা কা- না আ-মানা।” অর্থাৎ, যে হেরেম শারীফে প্রবেশ করলো, সে নিরাপত্তা পেয়ে গেলো।”-[সূরাহ্ : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭] 

উক্ত আয়াতে কারীমার ভিত্তিতে হেরেম শারীফের অভ্যন্তরে ঝগড়া-ফাসাদ, খুন-খারাবি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি হেরেম শারীফের সীমানায় ক্ষতিকর প্রাণী যেমন সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি ছাড়া কোনো প্রাণী হত্যা নিষেধ। আর মু’মিনদের শান-মান-মর্যাদা তো অনেক উর্ধ্বের ব্যাপার। তাই ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} চিন্তা করেছিলেন যে, নিশ্চয়ই ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} হেরেম শারীফের পবিত্রতার কথা বিবেচনায় এখানে সকল প্রকার অন্যায় অপকর্ম থেকে বিরত থাকবে। এই মনোভাব নিয়ে তিনি মাক্কাহ্ শারীফ চলে আসেন। 

এমনও হতে পারতো যে, সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বাকি জীবন হেরেম শারীফে অবস্থান করে মহান আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর ইবাদাত-বান্দিগি ও দ্বীনি তালীম-তালকীনে কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর পক্ষ থেকে কী ঘটবে তা-ই আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাই। 


⚜️ কারবালার সঠিক ইতিহাস ⚜️ 

⚜️ ধারাবাহিক পর্ব : ০৩ ⚜️ 

⚜️ হিজরি : ১৪৪৫ ⚜️ 

⚜️ শাহাদাতের কারণ ও প্রেক্ষাপট : 

যখন কোন ঘটনা অবশ্যম্ভাবী হয়, তখন তার সংঘটিত হওয়ার কার্যকারনও সৃষ্টি হয়ে যায়। ইমামে আলী মাকাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাহাদতের কারণসমূহ প্রেক্ষাপটও এভাবে তৈরী হয়ে যায়। হিজরী ৬০ সনের রজব মাসে বিশিষ্ট সাহাবী মুসলিম বিশ্বের ৬ষ্ঠ খলীফা হযরত আমীর মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ইন্তেকাল করেন। তাঁর পুত্র ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর জন্য পূর্ব থেকেই তিনি বাইআত নিয়ে রাখেন। ফলে তাঁর ওফাতের পর ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্} তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়। 

📌 ক্ষমতার আরোহনের পর ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল হযরত ইমাম হুসাইন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে উমার {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর বাইয়াত (আনুগত্য) গ্রহণ করা। কেননা তাঁরা ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর ‘যুবরাজ’ হওয়াকে প্রথম থেকেই স্বীকার করেননি। এ ছাড়াও তাঁদের ব্যাপারে ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর আশংকা ছিল যে, তাঁদের কেউ আবার না খিলাফাতের দাবী করে বসে। কিংবা এমনও হতে পারে যে, সমগ্ৰ হিজায (মাক্কাহ্, মাদীনা, তায়িফ শহরগুলো) ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। অধিকন্তু হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে খলীফা বানানোর দাবীতে ইরাকে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ার জোরালো সম্ভাবনা ছিল। 

এসব আশংকার কারণে ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নিজ ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত ও নিষ্কন্টক করে দেয়া। একারণে সে উক্ত ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য আদায় করা জরুরী বলে মনে করে। সুতরাং সে মাদীনা শারীফের গভর্নর ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে প্রথমে হযরত আমীর মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর ওফাতের সংবাদ জানায় এবং সাথে সাথে বর্ণিত তিনজন বুযূর্গ থেকে বাইয়াত গ্রহণের জন্য অত্যন্ত কঠোর নির্দেশ প্রেরণ করে। 

সে নির্দেশনামায় ইয়াযীদের ভাষা ছিল,—“হুসাইন, আবদুল্লাহ ইবনে উমার ও ইবনে যুবাইর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে এমনভাবে পাকড়াও করো যেন বাইয়াত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি না পায়।” [রেফারেন্স : ইবনে আছীর ৪/৪।] 

এখনও পর্যন্ত মাদীনাবাসীদের কাছে হযরত আমীরে মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর ওফাতের খবরও পৌঁছেনি। ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর এ হুকুম পেয়ে মাদীনা শারীফের গভর্নর ওয়ালীদ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। কেননা এ নির্দেশ কার্যকর করা তার জন্য ছিল দুরূহ ব্যাপার এবং এর পরিণাম সম্পর্কেও তিনি ভালই আন্দাজ করতে পারতেন। 

তিনি তাঁর নায়িব (উপদেষ্টা) মারওয়ান বিন হাকাম {লা’নাতুল্লাহ্}-কে ডেকে এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন। মারওয়ান ছিল নির্দয় ও উগ্রস্বভাবের। সে জানাল,—“আমার পরামর্শ হচ্ছে ঐ তিনজনকে এখনই ডাকুন এবং বাইয়াতের হুকুম দিন। তাঁরা যদি বাইয়াতে স্বীকৃত হন তো ভালই, যদি অস্বীকার করেন তবে তিনজনকেই শিরচ্ছেদ করে দিন। যদি আপনি তা না করেন, তবে যখনই তারা মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর ওফাতের খবর পাবেন তিন জনই এক এক অঞ্চলে গিয়ে খিলাফতের দাবীদার হয়প দাঁড়াবেন। তখন তাদের দমিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হবে। তবে ইবনে উমারকে আমি জানি তার পক্ষ থেকে এ আশংকা কম। যেচে খিলাফাত না দিলে তিনি হাঙ্গামা করতে চাইবেন না।” 

এ পরামর্শের পর ওয়ালীদ তিন ব্যক্তিবর্গকে ডেকে পাঠালেন। ঐ সময় হযরত হুসাইন এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} উভয়ে মসজিদে নববী শারীফে ছিলেন। তখন সময়টাও এমন ছিল যে, তাঁদের কারো সাথে ওয়ালীদের এ সময় যোগাযোগ বা মেলামেশা হতো না। দূত এসে তাঁদের কাছে, আমীরের বার্তা পৌঁছাল। সংবাদবাহককে তাঁরা বললেন,—“ঠিক আছে, তুমি যাও, আমরা আসছি।” 

এরপর হযরত ইবনে যুবাইর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে বললেন,—“আপনার কী মনে হয় আমীর যে সময় কারো সাথে দেখা করেন না, কাউকে সাক্ষাৎ দেন না, এমন একটি মূহুর্তে তিনি আমাদের কেন ডাকলেন?” 

হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—”আমার মনে হয়, আমীরে মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} আর নেই। আর আমাদের এ উদ্দেশ্যেই ডাকছেন যে, তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ সর্বমহলে প্রচারিত হওয়ার আগেই তিনি আমাদের কাছ থেকে ইয়াযিদের পক্ষে বাইয়াত নিয়ে নেবেন।” 

হযরত ইবনে যুবাইর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—“আমারও তাই মনে হচ্ছে। এখন আপনার অভিপ্রায় কী?” 

হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—”আমি জন কয়েক যুবককে সাথে নিয়ে যাচ্ছি, কেননা আমার অস্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবত নাজুক পরিস্থিতির অবতারণা হতে পারে।” 

যাই হোক, প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতঃ হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ওয়ালীদের কাছে পৌঁছলেন। যুবকদের ঘরের বাইরে নিয়োজিত রাখলেন এবং তাদের নির্দেশ দিলেন,—“যদি আমি তোমাদের ডাকি অথবা যদি তোমরা আমার উচ্চস্বর শুনতে পাও, তবে তাৎক্ষণিকভাবে চলে আসবে। আর এছাড়া যতক্ষণ আমি বাইরে না আমি ততক্ষণ এখান থেকে একচুল নড়বে না।” এরপর তিনি ভেতরে গেলেন। 

ওয়ালীদ তাঁকে হযরত আমীর মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর ওয়াফাতের সংবাদ জানালেন এবং ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর নির্দেশও জানিয়ে দিলেন। 

হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} সমবেদনা জানানোর পর বললেন,—“দেখুন, আমার মত একজন ব্যক্তি এভাবে চুপে চুপে বাইয়াত করতে পারে না। আর এরূপ গোপনে বাইয়াতে সম্মত হওয়া আমার উচিত নয়। যদি আপনি বাইরে এসে প্রকাশ্যে সর্বস্তরের লোকদের এবং তাদের সাথে আমাকেও বাইয়াতের আহ্বান জানান, তবে কথা হতে পারে।” 

ওয়ালীদ শান্তিপ্রিয় ও সমঝোতার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি বললেন,—“বেশ, আপনি তাশরীফ নিয়ে যান।” 

হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} উঠে চলে আসছিলেন। কিন্তু পাপীষ্ঠ মারওয়ান {লা’নাতুল্লাহ্} এ ঘটনাতে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে ওয়ালীদকে বললো,—“আপনি যদি এ মূহুর্তে তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ না করে ছেড়ে দেন, তবে পরে তাকে বাগে আনতে পারবেন না । না জানি তো বহু লোকের এতে প্রাণহানি হতে পারে। তাঁকে গ্রেফতার করুন। বাইয়াতে স্বীকৃত হলে তো উত্তম, নচেৎ তাঁকে কতল করুন।” 

একথা শুনামাত্র হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} দাঁড়িয়ে পড়লে এবং বললেন,—“হে ইবনে যারকা, তুমিই আমাকে কল করবে, না ইনি করবেন? খোদার কসম তুমি মিথ্যুক এবং ইতর।” এটা বলেই তিনি বেরিয়ে এলেন। 

মারওয়ান {লা’নাতুল্লাহ্} ওয়ালীদকে বললো,—“আপনি তো আমার কথা রাখলেন না, খোদার শপথ, এখন আপনি তাকে কাবু করতে পারবেন না, তাঁকে হত্যা করার এটা মোক্ষম সুযোগ ছিল।” 

ওয়ালীদ বললেন,—“আফসোস, তোমার দুর্ভাগ্য দেখে করুণা হয়। তুমি আমাকে এমন পরামর্শ দিচ্ছ, যাতে আমার দ্বীন ধর্মের চরম সর্বনাশ হয়। আমি কি শুধু ইয়াযিদের বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করার কারণেই নাবীজির প্রিয় দৌহিত্রকে কতল করবো? পৃথিবী পরিমাণ মাল সম্পদও যদি আমাকে দেওয়া হয়, তথাপিও আমি তাঁর পবিত্র রক্তে নিজ হাত রঞ্জিত করতে পারিনা। খোদার কসম, ক্বিয়ামাতের দিন হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর খুনে যেই অভিযুক্ত হবে, আল্লাহর সামনে অবশ্যই সে নেকীহারা হবে।” 

মারওয়ান {লা’নাতুল্লাহ্} বললো,—“আপনি ঠিকই বলেছেন।” তবে এটা সে বাহ্যতঃ মৌখিক ভাবেই বলেছিল। নয়তো ওয়ালীদের কথা সে মন থেকে অপছন্দই করেছিল। [রেফারেন্স : ইবনে আছীর, তাবরী।] 

👉 ওয়ালীদের কাছ থেকে ফিরে আসার পর হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর আনুগত্য তাঁর কাছে মনে প্রাণে অপছন্দনীয় ছিল। কেননা সে খিলাফাতের জন্য কোনো ভাবেই উপযুক্ত ছিল না। এছাড়া খলীফা হিসাবে তার নিযুক্তিও খুলাফায়ে রাশিদীন (প্রথম ৪ জন বিশিষ্ট সাহাবী ও সিনিয়র খলীফাগণ)-এর নৈর্বাচনিক ইসলামী পদ্ধতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং শারী‘আতের নীতিবর্জিতভাবে হয়েছিল। বরং হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর দৃষ্টিতে এটা রোম ও পারস্যের কায়সার ও কিসরার অনুসরণে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম একনায়কতান্ত্রিক প্রশাসন ছিল। এজন্যে তিনি স্পষ্টতঃই এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে পরিস্থিতি এটাও সমর্থন করছিলোনা যে, তিনি নিজে এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। 

অন্যদিকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বিভিন্ন কৌশলে ওয়ালীদের বার্তাবাহককে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওয়ালীদের কাছে আসেন নি। দ্বিতীয় দিন তিনি মাদীনা মুনাওয়ারা থেকে মাক্কাহ্ মুয়াজ্জামার দিকে রওয়ানা হয়ে যান। ওয়ালীদের কর্মচারীরা সারাদিন তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজে ফেরে। কিন্তু তাঁর সাক্ষাৎ লাভে ব্যর্থ হয়। 

এদিকে সন্ধ্যার দিকে ওয়ালীদ আবার হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর কাছে লোক পাঠালেন। তিনি বললেন,—“এখনই তো আমি যেতে পারছিনা, সকাল হোক, দেখি কী করা যায়।” 

ওয়ালীদ তা মেনে নেন, আর হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর সে রাতেই পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনসহ মাদীনা মুনাওয়ারাহ্ থেকে মাক্কাহ্ মুয়াজ্জামার চলে যেতে মনস্থ করেন। 

হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} পরিবারের সবাইকে বললেন,—“তোমরা (হিজরতের জন্য) তৈরী হয়ে যাও।” আর নিজে মাসজিদে নববী শারীফে রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}-এর রওযা পাকে এসে উপস্থিত হলেন। নফল নামায আদায় করতঃ নাবীজি {ﷺ}-এর চেহারা মুবারকের সামনে এসে যেই মাত্র বিনম্র বদনে সালাম পেশ করলেন, অজান্তেই চোখের পানি এসে গেল। তাঁর নানাজান রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}-এর সান্নিধ্য থেকে দূরে যাওয়া এবং নাবীজি {ﷺ}-এর শহর ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে করেই তিনি ব্যথিত হয়ে পড়েন। 

👉 এটাতো ঐ শহর, যাতে প্রিয় জিন্দেগীর এই পর্যন্ত এ শহরেরই আলোময় উন্মুক্ত পরিবেশ এবং সুরভিত হাওয়ায় তাঁর দিন রাতের পালাবদল ছিল। এটাতো প্রিয়তম নানাজানের শহর ছিল। হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ছিলেন নাবীজি {ﷺ}-এর প্রিয় বাগিচার সুবাস ছড়ানো ফুল। কিন্তু এখন? এই প্রিয় শহরে তাঁর অবস্থান করাটাই যে সঙ্গীন! এই শহরেই তো তাঁর শ্রদ্ধেয় জননীর পবিত্র সমাধি। তার সহোদর (ভাই) তো এখানেই চির শায়িত। এমনি একটি মূহুর্তে হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর মনের অবস্থা কী হতে পারে??? রওযায়ে রাসূল {ﷺ}-এ তাঁর সমগ্র আবেগ আর অনুভূতি উজাড় করে দিচ্ছিলেন। নানাজানের সামনে দাঁড়িয়ে অবস্থার বিবরণী দিচ্ছেন। 

❝দিনান্তে নাবীর সমাধি পাশে দাঁড়িয়ে ইমাম, 

অনুমতি চেয়ে পেশ করে দেন বিদায়ী সালাম। 

কান্নার মাঝে করেন ‘সালাম’ সৃষ্টির মহাজন, 

ভূবনের রাজ, নিবেদন করি সালাম, রাজন। 

একটু দেখুন, চেহারা পাকের খুলে অবগুণ্ঠন, 

আলীর তনয় হুসাইনের আজ মাদীনা বিজন। 

গুম্বাদ আর হুজরা ছেড়ে একটু দেখুন, 

নিজ ঘর হতে বিলাপের সুর নিজেই শুনুন। 

ইয়াযিদের তাপে ইসলাম আজ বিপন্ন হায়, 

দৌহিত্র তব অসহায় যেন শত্রুর ঘা’য়। 

কুরবান হই, দয়া দখিনায় বাড়ালে আমায়, 

বিপদের ওগো বিতাড়নকারী, গ্রাসে শংকায়। 

ব্যথিত হৃদয়, অসহায় জনে মান তো বাঁচান, 

দৃষ্টিতে আজি রাখুন, হে মি’রাজেরই মেহমান। 

প্রাণের হে নাথ, বিদায়ের ক্ষণে অনুমতি চাই, 

পবিত্র মূখে বলুন ‘বিদায় হুসাইন’, তবে যাই। 

মাদীনা ছেড়ে চলেছেন প্রিয় নাবীর নয়ন, 

নিজদেশ হতে পরদেশে চলে দেশের স্বজন।❞ 

অতঃপর হযরত ইমাম হুসাইন নিজ পরিবার-পরিজন নিয়ে মাদীনা মুনাওয়ারাহ্ থেকে মাক্কাহ্ মুয়াজ্জামাতে হিজরত করলেন। [ইবনে আছীর ৬/৪, তাবারী ১৯০/৬।] 


⚜️ কারবালার সঠিক ইতিহাস ⚜️ 

⚜️ ধারাবাহিক পর্ব : ০৪ ⚜️ 

⚜️ হিজরি : ১৪৪৫ ⚜️ 

⚜️ হযরত মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর পরামর্শ : 

সাইয়িদুনা হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর সৎ ভাই হযরত মুহাম্মাদ বিন হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} তাঁকে বললেন,—“ভাই, আমি আপনার চেয়ে কাউকে বেশী প্রিয় এবং সমাদৃত মনে করি না। আর খোদার সমগ্র সৃষ্টিতে কাউকে তার যোগ্যও ভাবি না যে, তার সাথে আপনার চেয়েও বেশী সদাচারণ করব। এজন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে, যতদূর পারা যায়, ইয়াযিদের বাইয়াত এবং বিশেষ কোনো শহরে অবস্থান করার ইচ্ছা থেকে আপনি মুক্ত থাকুন। নিভৃত কোনো পল্লী বা নির্জন মরুতে আপনি অবস্থান করুন এবং মানুষের কাছে আপনার দূত পাঠিয়ে আপনার প্রতি বাইয়াতের দাওয়াত দিন। যদি তারা বাইয়াত করে, তো আপনি আল্লাহর শোকর করবেন। আর যদি অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি বাইয়াতের প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছে যায়, তাহলে তাতে আপনার গুণাগুণ, বুযুর্গী বা মর্যাদার মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলা কোনো ঘাটতি বা তারতম্য আনবেন না। আমার ভয় হচ্ছে যে, এই অবস্থায় যদি আপনি কোনো নির্দিষ্ট শহরে বা বিশেষ কোন জনগোষ্ঠির কাছে যান, তবে, তাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়ে যাবে। একদল আপনার পক্ষ হবে, অন্যদল তার বিপরীত। ফলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়বে। আর সবার আগে আপনিই তাদের অস্ত্রের নিশানায় পরিণত হবেন। উদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে একজন সম্মানিত, সবচেয়ে সমাপ্ত এবং বংশ আভিজাত্যে যিনি সমগ্র উম্মাতের চেয়েও উত্তম, তাঁর পবিত্র রক্তই সবচেয়ে সস্তা হয়ে যাবে। তাঁরই পরিবার পরিজনকে লাঞ্চিত করা হবে।” 

এতদশ্রবণে হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—“তবে ভাই আমি কোথায় যেতে পারি?” 

হযরত মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—“আপাততঃ মাক্কাহ্ শারীফ। যদি সেখানে আপনার মনস্থির হয়, তবে কোনো না কোন উপায় বেরিয়ে আসবে। যদি মন প্রশান্ত না হয়, তবে ভিন্ন কোনো মরুস্থান বা পাহাড়ী এলাকায় চলে যাবেন। একস্থান থেকে অন্যস্থান পরিবর্তন করতে থাকবেন এবং মানুষের অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকবেন। পরিণামে আপনি অবশ্যই কোনো সিদ্ধান্ত পেয়ে যাবেন। কেননা ঘটনা যখন পর্যবেক্ষণ করা যায়, তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক বেশী নির্ভূল হয়।” 

হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—“ভাই, আপনি পরম হিতকামনা ও সহমর্মিতাই জানালেন। আমার মনে হয়, আপনার মতামতই ইনশাল্লাহ্ সঠিক ও যথাযথ বলে সাব্যস্থ হবে।” 

এই বলে তিনি কবি ইয়াযিদ ইবনে মুফাররাগের নিম্মোক্ত কবিতা প্রবাদমূলক আবৃত্তি করতে করতে মসজিদে প্রবেশ করলেন,

—”لا دعوت السوام فى فلق + الصبح مغيرا ولا دعيت يزيدة يوم أعطى من المهابة ضيما : والمنايا برصد على ان احيدا“ 

অর্থ : “যেদিন যুলুম নিপীড়নে আমার টুটি চেপে দেয়া হবে 

মৃত্যু এসে রইবে প্রতীক্ষায়, 

(সেদিন) যদি আমি সেই রণে ভঙ্গ, 

তবে ছুটাব না উঠ প্রভাত প্রভায়। 

না কেউ ইয়াজিদ বলে ডাকবে আমায়।” 

[রেফারেন্স : ইবনে আছীর : ৬/৪, ত্বাবরী : ১৯০/৬।] 

⚜️ একটি সংশয় : 

‘খিলাফাতে মুয়াবিয়া ওয়া ইয়াযিদ’ গ্রন্থের প্রণেতা লিখেছেন,—“মুহাম্মাদ হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর নিষ্ক্রমণকে হুকুমত ও খিলাফাত অন্বেষার এমন একটি রাজনৈতিক ইস্যু মনে করতেন, যা যুগপ্রেক্ষাপটে এবং শরয়ী আহকামের ভিত্তিতে বৈধ বা সমীচিন ছিল না।” [পৃষ্ঠা : ৭৯] 

📌 এ সম্পর্কে বক্তব্য হল, যদি হযরত মুহাম্মাদ হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর দৃষ্টিতে হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর পদক্ষেপ সময়ের চাহিদা ও শরয়ী আহকামের আলোকে নাজায়িয এবং অনুচিৎ হতো, তবে আবার তিনি হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে এটা কেন বললেন যে, ‘ইয়াযীদ থেকে দূরে থাকুন এবং নিজের জন্য বাইয়াতের দাওয়াত দিন?’ বরং সেক্ষেত্রে তিনি তো স্পষ্টতঃ বলতে পারতেন যে, ‘আপনার এই পদক্ষেপ শারী‘আত মতে কোনো অবস্থাতেই জায়িয নয়। আর একজন সত্যাশ্রয়ী ও ন্যায়নিষ্ঠ খলীফা থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে আপনার এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র দ্রোহিতার শামিল।’ 

তাঁকে নিষ্ক্রমনে বাঁধা না দেয়া এবং করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা, যেমন :- পল্লীতে ও পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান নিন, মানুষের কাছে প্রতিনিধি পাঠান, তাদের প্রতি আপনার পক্ষে বাইয়াতের আহবান জানান ইত্যাদি এ কথারই সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তাঁর দৃষ্টিতে হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর এই পদক্ষেপ ইসলামী শারী‘আত মতে নাজায়িয ছিল না বরং হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছিলেন তাঁর কাছে সে প্রক্রিয়াটাই শুধু যুক্তিসিদ্ধতার বিপরীত এবং নিষ্ফল মনে হয়েছিল। বাকী তাঁর নিজের বাইয়াত সংক্রান্ত ব্যাপারটি ছিল অন্যান্য সাহাবীদের {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} মতো ফিতনা ফ্যাসাদ এড়ানোর লক্ষ্যে। নচেৎ খলীফার কার্যক্রমের সৌন্দয্য কিংবা তাকে সঠিক বিবেচনার ভিত্তিতে নয়। 

📌 প্রমাণিত হল যে, হযরত মুহাম্মাদ হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর অপরাপর কতিপয় সাহাবী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর মতো ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্ }-এর বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়াকে নিজের কাছে অবৈধ বা খারাপ মনে করতেন না; বরং বাহ্যিক নানা কারণ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তা প্রতিক্রিয়াহীন ও দূরদর্শিতাহীন বলে ভেবেছিলেন। সুতরাং ‘খিলাফাতে মুয়াবিয়া ওয়া ইয়াযীদ’ এর লেখকের মন্তব্য “হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর পদক্ষেপকে হযরত মুহাম্মাদ হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} শারী‘আত মতে নাজায়িয মনে করতেন” এটা সম্পূর্ণ ভুল এবং ইতিহাসের প্রতি সর্বৈব মিথ্যাচার। 

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, হযরত মুহাম্মাদ হানাফিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর পরামর্শ দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার ভিত্তিতেই ছিল। জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার অধিকারী মাত্রই এরূপ যুক্তিসিদ্ধতা ও পরিণামদর্শিতার ভিত্তিতে কাজ করে থাকেন এবং অপরকেও এতে উৎসাহিত করেন। এছাড়া সময় বিশেষে কৌশল অবলম্বন করা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু ইশক্ব ও প্রেমের ধারক বাহকদের প্রকৃতি ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। বুদ্ধিজ্ঞান ও ইশক্ব-প্রেমের তারমতম্য নিরূপনে ডঃ ইকবালের দর্শন নিম্নরূপ : 

❝কার্যকারণের এমনি মারপ্যাঁচ, বুদ্ধিমত্তা ক্লান্ত হয়, 

প্রেম সে কর্মের এই যে প্রান্তর, প্রাণের বন্যায় অকুতোভয়। 

শংকা, ভয়, ডর, জ্ঞানের মূলধন, প্রতিটি ক্ষনে সে দেখছে সংশয়, 

প্রেমের নারী সে অটল, অবিচল, দীপ্ত সাহসে, অব্য্য, অক্ষয়। 

‘কেন’ বা ‘কি করে’ ‘কোথায়’ ‘কি হবে’ জ্ঞানের ভিত্তি এসবে নিশ্চয়, 

প্রেমতো সংশয় জানে না কদাচ, দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব-যুক্ত সদাশয়। 

ইশক্ব আপনা শক্তি, বিক্রম ত্যাজিবে, করবে নিজেরে ক্ষয়, 

বুদ্ধি ভাবনা খাটাতে তৎপর, বুননে জাল সে মগ্ন রয়। 

বুদ্ধি মিলবে যত্র তত্র, হাওয়ার মত সে প্রবাহে রয়, 

ইশক্ব না সহজে খুঁজলে পাব সে, সস্তা দামে সে পাওয়ার নয়। সারাটি বিশ্ব পূজক, ইশক্ব পূজ্য এমনি বিশ্বময়, 

বুদ্ধি যদি যে দূর্গ সোমনাথ, গজনী-মাহমুদ প্রেমেরই জয়। 

প্রেম সে সম্রাট ভূবনজোড়া সে প্রমাণ এমনি দীপ্তিময়, 

তাবৎ পৃথিবী প্রেমের সকাশে অবনত আর অধীন রয়। 

⚜️ মাদীনা মুনাওওয়ারাহ্ থেকে যাত্রা : 

সাইয়িদুনা হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর মাদীনা শারীফ ছেড়ে আসার প্রাক্কালে যখন স্বীয় নানাজান রাসূল {ﷺ}-এর রওযা মুবারকে উপস্থিত হন, সালাত ও সালাম আরয করার পর বিদায় অনুমতি চাইলেন, তখন তাঁর অবস্থা কী হতে পারে? বিষাদের রক্তিম অশ্রু অবিরাম ধারায় বর্ষিত ছিল! ব্যথিত হৃদয় বিরহ যাতনায় রক্তাক্ত ছিল। 

পবিত্র যবানে বলছিলেন,—কোলে কাঁধে বসিয়ে খাওয়াতেন যে নানা, মায়া-মমতার বাঁধনে জড়িয়ে ঘুম পাড়ানিয়া শুনাতেন যে নানা, মাথায়, কপালে, অধরে চুম্বনসিক্ত করতেন যে নানা, আমার গৌরবদীপ্ত নানা, আজ আমার অবস্থা দেখুন! বেদনা ভারাক্রান্ত আমি, অশ্রুসিক্ত আমি! আপনার এই পবিত্র শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি, এই শহর আমার সবচেয়ে আদরের, প্রিয়তম শহর, কিন্তু কী করব? এখানে থাকা আমার পক্ষে দুষ্কর আজ। আমি যাচ্ছি, আমাকে অনুমতি দিন।” 

আর ওদিকে মমত্ববোধে লালনকারী মাতামহ, নাবীকুল-রাজ রাসূলুল্লাহ্ {ﷺ}-এর কী অবস্থা? এ অবস্থার কল্পনা হৃদয়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলে, এটা কেমন দিন ছিল! অত্যন্ত বেদনা বিধুর কঠিন সে সময় নাবীজী {ﷺ}-এর দৌহিত্র হযরত আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর কলিজার টুকরা, সাইয়িদা ফাতিমা যাহরা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا‎}-এর নয়নজ্যোতি, হযরত হাসান মুজতাবা {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর আত্মার শান্তি চলে যাচ্ছেন, চিরতরো সেই যাওয়া। 

❝দেখ চেয়ে দেখ মনভরে সব, 

দেখ চেয়ে আজ সব মুমিন, 

বিদায়ী যাচ্ছেন কারবালায় আজ, 

নায়িবে হযরত আল আমীন। 

আকাশ থর থর ভয়ে কী অস্থির, 

ভূমিতে কম্পন ধরিত্রীর, 

মাঝখানে দেন ডানার ছায়া কে, 

তিনি সেই রূহুল আমীন। 

ফুল কলিরা শোন শোন সব, 

সুপ্ত কলি হে, বিদায়ী রব, 

দৃষ্টি নন্দন গলি মাদীনার, বিদায়! 

বাজিছে ব্যথার বীণ।❞ 

অতঃপর তিনি শাবান মাস, ৬০ হিজরী সনে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাক্কাহ্ মুকাররামার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। যাত্রাকালে পবিত্র মুখে তেলাওয়াত ছিল,—“فخرج منها خائفا يترقب قال رب تجنى من القوم الظالمين” 

অর্থ : “তিনি ঐ (শহর) জনপদ থেকে ভীতিগ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে পড়লেন, এ প্রতীক্ষায় যে, না জানি কী হবে! বললেন, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে এ জালিম গোষ্ঠী থেকে নাজাত দিন।” [সূরাহ্ :আল কাসাস, আয়াত নং : ২০।] 

⚜️ হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুতী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর সাক্ষাৎ : 

পথিমধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুতী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর সপরিবারে মাদীনা মুনাওওয়ারাহ্ থেকে চলে যেতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,—“আমি আপনার চরণে উৎসর্গ হবো, আপনি কোথায় চলেছেন?” 

তিনি বললেন,—“আপাততঃ তো মাক্কাহ্ মুকাররামার দিকে যাচ্ছি, সেখানে পৌঁছে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ‘ইস্তেখারা’ (সিদ্ধান্ত গ্রহণে আল্লাহর ইঙ্গিত খুঁজে দেখা) করে দেখব কোথায় যাওয়া যায়।” 

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুতী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বললেন,—“আল্লাহ্ আপনাকে স্বস্থি ও নিরাপদে রাখুন, এবং আমাকে আপনার উদ্দেশ্যে নিবেদিত করুন। যখন আপনি মাক্কাহ্ শারীফ পৌঁছবেন, তখন দয়া করে কখনো ‘কূফা’ যাওয়ার খেয়াল করবেন না। কেননা সে এক অলক্ষুনে জায়াগা, আপনার বুযুর্গ পিতা সেখানে শহীদ হয়েছেন। আর সেখানেই আপনার সহোদর (বড় ভাই) হযরত হাসান {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে বান্ধবহীন, অসহায় অবস্থায় রেখে আসা হয়। তাঁর উপর বর্শার আঘাত হানা হয়পছিল। ফলে মরণদশায় উপনীত হয়েছিলেন। আপনি মাক্কাহ্তেই অবস্থান করুন। মাক্কাহ্ ত্যাগ করে যাবেন না। আপনি আরবকুল সর্দার, হিজাযবাসী (মাক্কাহ, মাদীনা, তায়িফবাসী) কাউকেই আপনার সমকক্ষ মনে করে না। চতুর্দিক থেকে মানুষ আপনার কাছেই ছুটে আসবে। আমার চাচা এবং মামা আপনার জন্য ক্বুরবান। আপনি কা’বার হেরেম কোনো অবস্থাতেই কখনোই ছাড়বেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে! খোদা না করুন, যদি আপনি শহীদ হয়ে যান, তবে আপনার পরে আমাদের সবাইকেই ক্রীতদাস বানিয়প রাখা হবে।” 

যখন তিনি মাক্কাহ্ মুকাররামায় প্রবেশ করলেন, তখন আপাততঃ স্বস্থিবোধে পবিত্র ক্বুরআনের এই আয়াতে মুবারাকা তিলাওয়াত করলেন, 

”ولما توجه تلقاء مدين قال عسى ربي ان يهديني سواء السبيل“ 

অর্থ : “যখন তিনি ‘মাদইয়ান’ এর প্রতি মনোনিবেশ করলেন, তখন বললেন, আশা করি আমার প্রভু আমাকে সরল পথে চালিত করবেন।” [সূরাহ্ : কাসাস, আয়াত নং : ২০।] 

হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর মাক্কাহ্ মুকাররামায় পৌঁছার সংবাদ পেয়ে মানুষ দলে দলে তাঁর কাছে আসতে লাগল এবং সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হতে লাগল। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-ও মাক্কাহ্তেই ছিলেন। তিনিও হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর কাছে আসা-যাওয়া করতে লাগলেন। মাক্কাহবাসীরা তাঁর আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত হল। তাঁরা তাঁর নুরানী সান্নিধ্যে নিজেদের নয়নমন উদ্ভাসিত করতঃ বলতে লাগল,— 

❝স্বাগতম হে আগমনে যাঁর, খুশী হল সব, 

চেহারা দেখেই খুশী উতরোল হৃদে অভিনব। 

চেয়েছিনু মোরা খোদার সকাশে তোমার মিলন, 

তোমার চলার তীর্থ পথেই এই দৃষ্টি মগন। 

‘মারহাবা’ রাজাধিরাজের ওগো নয়নমনি, 

ফাতেমার বুকে সাতরাজ ধন, শুন হর্ষধ্বনি। 

নাবুওয়াতরূপ বাগিচার ফুল এলো, এলো আজ, 

ধরার জ্যোতি চন্দ্র অতুল, এলো এলো আজ। 

হারামাইনের ওগো দীপ্তি, মোরা ধন্য মানি, 

হুসাইন এলো, খুলল মোদের কপালখানি।❞ 



⚜️ কারবালার সঠিক ইতিহাস ⚜️

⚜️ ধারাবাহিক পর্ব : ০৫ ⚜️ 

⚜️ হিজরি : ১৪৪৫ ⚜️ 

⚜️ কুফাবাসীর চিঠি ও প্রতিনিধি : 

কূফা ছিল বিশিষ্ট সাহাবী ইসলামী বিশ্বের ৪র্থ খলীফা সাইয়িদুনা হযরত আলী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর অনুরক্ত ও ভক্তদের প্রাণকেন্দ্র। কারণ তিনি নিজ খিলাফাতকালে মাদীনা মুনাওয়ারাহ্ থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করে কূফায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কাজেই তার সকল ভক্ত প্রেমিক সেখানেই বসতি গড়ে ছিলেন। ৬ষ্ঠ খলীফা সাইয়িদুনা আমীরে মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাসনামলেও হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে কূফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছিল। এখন যেইমাত্র কূফাবাসী হযরত মুআবিয়া {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর ইন্তেকাল এবং হুসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর ও আব্দুলাহ্ ইবনে উমার {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} ব্যক্তিত্রয়ের ইয়াযিদ {লা’নাতুল্লাহ্}-এর হাতে বাইআত গ্রহণের অস্বীকৃতির সংবাদ জানতে পারল, তখন কূফার সকল অনুরক্ত সুলাইমান ইবনে ছারদ আল খোযায়ীর ঘরে একত্রিত হয়ে যায়। 

মুহাম্মাদ ইবনে বিশর হামদানী বর্ণনা করেন,—“সকল শিয়া সুলাইমান বিন ছারদ এর ঘরে সমবেত হয়ে গেল এবং আমীরে মুআবিয়ার ইন্তেকালের কথা আলোচনা করে সবাই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জানাল (না‘উযুবিল্লাহ্)। অতঃপর সুলাইমান সবার উদ্দেশ্যে বলল,—“মুআবিয়ার অবসান হয়েছে, আর ইমাম হুসাইন ইয়াযিদের বাইআত প্রত্যাখ্যান করে মাক্কাহ্ শারীফে চলে গিয়েছেন। আর তোমরা তো ইমাম হুসাইন ও তাঁর আব্বাজানের শিয়া (ভক্ত)। তোমরা ভালভাবে জেনে নাও, যদি তোমরা তাঁর দুশমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম হও, তবে তাঁর কাছে লিখে দাও। যদি নিজেদের দূর্বলতা সাহসের অভাব বোধ কর, তবে তাঁকে ধোঁকা দিও না।” 

সবাই সমস্বরে বলল,—“না আমরা তাঁকে ধোঁকা দিব না; আমরা তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ব এবং তাঁর জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করব।” 

সুলাইমান বলল,—“তবে লিখ!” 

তখন তারা তাঁর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে।” [রেফারন্স : ত্বাবরী ৬/১৯৭।] 

📌 শিয়া মাজহাবের উল্লেখযোগ্য কিতাব “আলাউল উয়ূন” (কৃত মোল্লা বাকের মজলিসী ইস্পাহানী)-এ রয়েছে,—“কূফাবাসীদের কাছে যখন এ সংবাদ পৌঁছে, তখন কূফার সকল শিয়া সুলাইমান বিন ছারদ খোজারীর ঘরে সমবেত হলো, হামদ ও সানা (আল্লাহর প্রশংসা) আদায় করল। অতঃপর মুআবিয়ার তিরোধান ইয়াযিদের বাইআত প্রসংগে কথাবার্তা হয়। সুলাইমান বললেন,—“যখন মুআবিয়া মারা গেছে, (মাআযাল্লাহ্! শিয়াদের ভাষ্য হুবহু রাখতেই এরূপ অনুবাদ করা হলো। ‘আহলে সুন্নাত’ অর্থাৎ আমাদের ভাষা এরূপ নয়।)' ইমাম হুসাইন ইয়াযিদের বাইআতকে প্রত্যাখ্যাত করে মাক্কায় চলে গেছেন। আর তোমরা তাঁর এবং বুযুর্গ পিতার ভক্ত প্রেমিক, যদি মনে করো, তোমরা তাঁর সাহায্য করতে পারবে এবং জানমাল দিয়ে তাঁর সহযোগিতায় প্রচেষ্টা চালাতে পারবে, একটা চিঠি লিখে তাঁকে এখানে আমন্ত্রণ জানাও। আর যদি তাঁর সাহায্যের ব্যাপারে অলসতা ও দুর্বলতা অনুভব করো, জেনে রাখ, শুভাকাঙ্খীর দায়িত্ব ও আনুগত্য যদি সম্পাদন করতে না পারো, তবে তাকে ধ্বংসের মাঝে ঠেলে দিওনা।” 

শিয়ারা বলল,—“যখন তিনি নুরানী পদার্পনে এ শহরকে ধন্য করবেন, আমরা সবাই পরিশুদ্ধ চিত্তে তাঁর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে বাইআত গ্রহণ করব, এবং তাঁর সাহায্যে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে শত্রুর আক্রমণ থেকে তাঁকে হিফাজত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব।” [শিয়াদের কিতাব থেকে রেফারেন্স : আলাউল উয়ূন (অনূদিত) ২ঃ১৩৮, শিয়া জেনারেল বুক এজেপি, শিয়া মহল্লা, লাহোর কর্তৃক প্রকাশিত।] 

👉 প্রমাণিত হল :- হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে কূফায় আহবানকারী সকলে শিয়াই ছিল। বস্তুত চিঠিপত্র ও প্রস্তাবকের লাইন পড়ে গেল। এমনকি মোল্লা বাকের মজলিসীর বর্ণনা মতে শিয়াদের পক্ষ থেকে বার হাজার চিঠি হযরত হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর কাছে পৌঁছে। বিষয় বস্তুর সারাংশ হচ্ছে,—“আপনি অবিলম্বেই কূফায় তাশরীফ আনুন, (আগমন করুন) খিলাফাতের মসনদ আপনার জন্যই খালি রয়ে গেছে। শিয়া মু’মিনদের ধন-দৌলত এবং তাদের গর্দানসমূহ আপনার জন্য প্রস্তুত। এখানকার সকলেই আপনার অপেক্ষায় এবং আপনার দর্শন লাভে আগ্রহী। আপনি ছাড়া আমাদের আর কোনো ইমাম ও পথনির্দেশক নাই। আপনার সাহায্যের জন্য এখানে সৈন্য সামন্ত তৈরী এবং উপস্থিত। নু’মান ইবনে বাশীর কূফার গর্ভনর রাজপ্রাসাদে অবস্থান করছেন। আমরা জুম‘আ কিংবা ঈদের জামাতেও যাই না, যখন আপনি শুভাগমন করবেন, তখন আমরা তাদেরকে কূফা থেকে বের করে দেব।” [শিয়াদের কিতাব থেকে রেফারেন্স : জালাউল উয়ূন, ১৩৯/২] 

📌 শেষ চিঠি আসার পর হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} তাদের প্রতি উত্তর লিখেন :- “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম— এ চিঠি হুসাইন ইবনে আলীর পক্ষ থেকে। কূফাবাসী ভক্ত মু’মিনদের প্রতি লিখিত। অনেক দূত এবং চিঠিপত্র আসার পর যে চিঠি আপনারা হানী ও সায়িদ এর হাতে প্রেরণ করেছেন, তা আমি পেয়েছি। আপনাদের সবগুলো চিঠি আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। সব চিঠিরই বিষয় সম্পর্কে আমি জানলাম। আপনারা প্রায় সব চিঠিতে আমাকে লিখেছেন আমাদের কোন ইমাম নেই, আপনি অতি সত্তর আমাদের মাঝে তাশরীফ আনুন। আপনার বদৌলতে আল্লাহ্ আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন। এখানে স্মর্তব্য যে, আমি কার্যতঃ আপনাদের কাছে আমারই চাচাতো ভাই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব জনাব মুসলিম ইবনে আকীলকে পাঠাচ্ছি। মুসলিম যদি আমাকে জানান যে আপনারা যা কিছু লিখেছেন, তা সর্বজন শ্রদ্ধেয় চিন্তাশীল, জানী-গুনি এবং এলাকার গন্যমান্য বুযূর্গগণের পরামর্শক্রমেই লিখেছেন, তখন খুব শীঘ্রই আমি আপনাদের কাছে চলে আসব, ইনশাআল্লাহ্। আমি মূল্যবান এ জীবনের শপথ করেই বলছি, সত্যিকার ইমামের বৈশিষ্ট্য হল, তিনি মানুষকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী নির্দেশনা দেন, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন, পবিত্র শারী‘আতের বাইরে একটি কদমও দেন না, আর মানুষকে সঠিক দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন। “সালাম”।”-[রেফারেন্স : জালাউল উয়ূন, ১৪০/২।] 

হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} যখন আহলে কূফার (কূফাবাসীর) চিঠি ও দূতপ্রেরণ থেকে তাদের দ্বীনি জযবা ও মুহাব্বাত, জানমাল উৎসর্গ করার ইচ্ছা এবং কূফায় তাঁর আগমনকে স্বাগত জানাবার প্রবল বাসনা অনুভব করলেন, তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রথমতঃ তাঁর চাচাত ভাই সাইয়িদুনা হযরত মুসলিম ইবনে আকীল {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে অবস্থা পর্যবেক্ষনের জন্য পাঠানো উচিৎ। 

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি হযরত মুসলিম ইবনে আকীল {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে একটি চিঠি দিলেন, যা তিনি কূফাবাসীর বরাবরে লিখেছিলেন। আর বললেন—“আপনি কূফায় গিয়ে সঠিক উপায়ে নিজেই সরেজমিনে অবস্থা ও পরিস্থিতির যথাযথ পর্যবেক্ষন করবেন এবং আমাকে অবহিত করবেন। পরিস্থিতি অনুকূলে হলে আমিও চলে আসব আর যদি পরিস্থিতি বিরূপ হয় তবে আপনি ফিরে আসবেন।” 

📍 সদরুল আফায়িল হযরত মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মাদ নাঈমউদ্দীন সাহেব মুরাদাবাদী {رحمة الله عليه} বর্ণনা করেন,—“যদিও ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর শাহাদাতের ভবিষ্যৎবাণী সুপ্রসিদ্ধ ছিল এবং কূফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা ছিল পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ; কিন্তু ইয়াযিদ যখন বাদশাহ্ হয়ে বসলো এবং তার হুকুমত ও রাজত্ব দ্বীন-ধর্মের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিল, এ কারণেই তার বাইআত নাজায়িয (অবৈধ) ছিল, আর সে (ইয়াযিদ) বিভিন্ন রকম কলাকৌশল নানান বাহানায়  এটাই চাচ্ছিল যে, লোকেরা তার আনুগত্য স্বীকার করুক, এরূপ পরিস্থিতিতে কূফাবাসীদের ইয়াযিদের বাইআত থেকে নিবৃত্ত করে ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর বাইআত গ্রহণ করানো দ্বীন ও মিল্লাতের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর উপর ফরজ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যাতে তাদের একান্ত ফরিয়াদ ও আবেদন প্রত্যাখ্যাত না হয়। 

যখন কোনো সম্প্রদায় ‘জালিম’ (অত্যাচারী) ও ‘ফাসিক’ (দূরাচার) এর বাইআত (বশ্যতাগ্রহণ) করতে সম্মত না হয় এবং যোগ্যতাসম্পন্ন সঠিক পাত্রে বাইআত নিতে দরখাস্ত করে এ অবস্থায় যদি তিনি ঐ দাবী মনজুর না করেন, তবে তার অর্থই দাঁড়ায় যে, তিনি ঐ সম্প্রদায়কে ঐ অত্যাচারীরই হাতে ন্যস্ত করতে চান। ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} যদি ঐসময় কূফাবাসীর আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করতেন, তবে আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর দরবারে কূফাবাসীর ঐ দাবীর প্রসঙ্গে ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর পক্ষ থেকে কী জবাব হতো? অর্থাৎ- (কূফাবাসী চিঠিতে লিখেছিল, তিনি না এলে কাল হাশরের ময়দানে তারা আল্লাহ্ {سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ‎}-এর কাছে বিচার চাইবে) আমরা তো সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, কিন্তু ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} বাইআত করানোর জন্য রাজী হননি এবং এ কারণেই ইয়াযিদের জুলুম নিপীড়নে নিরুপায় হয়ে আমাদেরকে তার হাতে বাইআত হতে হয়। যদি ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} হাত বাড়াতেন, তবে আমরা তাঁর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম।” 

ব্যাপারটি এমন নাজুক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল যে তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর গত্যন্তর ছিল না। যদিও শীর্ষস্থানীয় সাহাবীদের মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত ইবনে উমার, হযরত জাবির এবং হযরত আবু ওয়াকিদ লাইসী {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎} প্রমুখ ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন না এবং কূফাবাসীর ওয়াদা অঙ্গীকার সম্পর্কে তাদের আস্থা ছিল না। হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর প্রতি মুহাব্বাত, তাঁর শহীদ হওয়ার কথার প্রসিদ্ধি তাঁদের মনে আশংকার জন্ম দিচ্ছিল। কেননা এটা বিশ্বাস করারও কোনো কারণ ছিল না যে, শাহাদাতের এটাই সময় এবং এ সফরেই ঐ মুহূর্ত সামনে এসে দাঁড়াবে। 

হযরত ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর সামনে বিষয়টি এরূপ উপস্থিত হয়েছিল যে, তাদের দাবীকে অগ্রাহ্য করার মতো ইসলামী শার‘য়ী ওজর কী হতে পারে? একদিকে এমন সম্মানিত সাহাবায়ে কিরাম {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর পীড়াপীড়িকে গুরুত্ব দেয়া, অপর দিকে কূফাবাসীর আবেদন ফেরানোর মতো শারী‘আত সম্মত কোনো অপারগতা খুঁজে না পাওয়া ইমাম হুসাইন {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-এর জন্য জটিল বিষয় ছিল। এমন জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য একমাত্র উপায় যেটা তিনি পেলেন, সেটা হলো হযরত মুসলিম {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে প্রথমে পাঠানো, যদি কূফাবাসী অঙ্গীকার ভঙ্গ কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ করে, তবে তো শার‘য়ী ওজর পাওয়া গেল, যাতে সেখানে যাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। তবে সাহাবায়ে কিরাম {رَضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهُ‎}-কে কোনো না কোনো সান্তনা দেওয়া যাবে। [রেফারেন্স : সাওয়ানেহে কারবালা, পৃষ্ঠা নং : ৫২।] 

প্রতিনিধি স্বরূপ তাকে বেছে নিলেন আজ ইমাম, 

পাঠিয়ে দিলেন কূফাবাসীর নামে লিখে চিঠি ও খাম। 

তোমাদেরই দাবীর মুখে পাঠিয়ে তাঁকে এই দিলাম, 

‘সাহায্য’ ও ‘রক্ষা’ পূরণ করো মনোষ্কাম। 

চিঠি নিয়ে মুসলিম আজ ছাড়েন সে পাক মাক্কাহ্ধাম, 

কূফার পথে চলেন তিনি, মুখে নিয়ে আল্লাহর নাম। 

করে না তারা আহলে বাইতে পাকের অনুসরণ, 

ইশক্ব ও প্রেমের দাবী করে তবু মানে না অনুগমন। 

#পবিত্র #মুহাররম #মাস #কারবালা #এর #সঠিক #ইতিহাস #Muharram #truestory #history #of #karbala #muharram1445 #WeLoveMuhammadﷺ #ImamHussainAS #Ahle_Bait_E_Rasoolullah #WeFollowMuhammadﷺ #AhleBayt #OProphetMuhammadﷺMyParentsMyLifeAndMyPropertyAreAllSacrificedAtYourHolyFeet  #MuharramUlHaram #WeAreUmmahOfMuhammadﷺ #imamhussain #ahlulbayt #10muharram #1445hijri #tibbeilaheandtibbenawabi 

 
back to top